১। সূরা ফাতিহা
সূরা ফাতিহা
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু1. যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার যিনি সকল
সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।
2. যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু।
3. যিনি বিচার দিনের মালিক।
4. আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং
শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
5. আমাদেরকে সরল পথ দেখাও,
6. সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে
তুমি নেয়ামত দান করেছ।
7.তাদের পথ নয়,
যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং
যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
(শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। 2. যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। 3. যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু। 4. যিনি বিচার দিনের মালিক। 5. আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। 6. আমাদেরকে সরল পথ দেখাও, 7. সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।
In the name of Allah, the Beneficent,
the Merciful.
All the praises and thanks be to Allah,
the Lord of the ‘Âlamîn (mankind, jinn
and all that exists). The Most Gracious, the Most Merciful The Only Owner (and the Only Ruling
Judge) of the Day of Recompense (i.e. the
Day of Resurrection) You (Alone) we worship, and You
(Alone) we ask for help (for each and
everything).Guide us to the Straight Way.
The Way of those on whom You have
bestowed Your Grace, not (the way) of
those who esuch as the Christians).arned Your Anger (such as
the Jews), nor of those who went astray
সূরা ফাতিহা
মক্কায় অবতীর্ণ ১ম পূর্ণাঙ্গ সূরা
সূরা ১, আয়াত ৭, শব্দ ২৫, বর্ণ ১১৩।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।[1]
(১) যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগত সমূহের প্রতিপালক। |
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
|
(২) যিনি করুণাময় কৃপানিধান। |
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
|
(৩) যিনি বিচার দিবসের মালিক। |
الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
|
(৪) আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। |
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
|
(৫) তুমি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর। |
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
|
(৬) এমন ব্যক্তিদের পথ, যাদেরকে তুমি পুরস্কৃত করেছ। |
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
|
(৭) তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে। (আমীন! তুমি কবুল কর!) |
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
|
সূরা (السُّوْرَةُ) অর্থ উঁচু স্থান, সীমানা প্রাচীর। আয়াত (الآيَةُ) অর্থ নিদর্শন। কুরআনের একাধিক আয়াত সম্বলিত একটি অংশকে ‘সূরা’ এবং অনেকগুলি আয়াত সম্বলিত এক একটি ভাগকে ‘পারা’ (الْجُزْءُ) বলা হয়। কুরআনের শব্দ ও বাক্যসমূহ আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ হিসাবে এগুলিকে আয়াত বা নিদর্শন বলা হয়। পবিত্র কুরআনে ৩০টি পারা ও ১১৪টি সূরা রয়েছে। কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা হ’ল ‘বাক্বারাহ’ এবং ছোট সূরা হ’ল ‘কাওছার’। প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ রয়েছে, কেবল সূরা তওবাহ ব্যতীত। পবিত্র কুরআনের আয়াত সংখ্যা ৬২০৪ থেকে ৬২৩৬, শব্দ সংখ্যা ৭৭৪৩৯ এবং বর্ণ সংখ্যা ৩,৪০,৭৫০ (কুরতুবী)। ঈমানের সাথে কুরআনের প্রতিটি বর্ণ পাঠে ১০টি করে নেকী হয়’।[2] রামাযান মাসে এই নেকীর পরিমাণ ১০ থেকে কেবল ৭০০ গুণ নয় বরং এর কোন সংখ্যা-সীমা থাকে না। কেননা তখন আল্লাহ নিজ হাতে সীমাহীন নেকী দান করে থাকেন।[3]
‘সূরাতুল ফাতিহাহ’ অর্থ মুখবন্ধ বা ভূমিকার সূরা। ইমাম কুরতুবী বলেন, একে ‘ফাতিহাহ’ এজন্য বলা হয় যে, এই সূরার মাধ্যমে কুরআন পাঠ শুরু করা হয়। এই সূরার মাধ্যমে কুরআনের সংকলন কাজ শুরু হয়েছে এবং এই সূরার মাধ্যমে ছালাত শুরু করা হয়’।[4]এটি মক্কায় অবতীর্ণ ১ম ও পূর্ণাঙ্গ সূরা। এতে ৭টি আয়াত, ২৫টি কালেমা বা শব্দ এবং ১১৩টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে।[5] সূরাটি কুরআনের মূল, কুরআনের ভূমিকা ও ছালাতের প্রতি রাক‘আতে পঠিতব্য সাতটি আয়াতের সমষ্টি ‘আস-সাব‘উল মাছানী’ নামে ছহীহ হাদীছে[6] ও পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহপাক এরশাদ করেন, وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعاً مِّنَ الْمَثَانِيْ وَالْقُرْآنَ الْعَظِيْمَ ‘আমরা তোমাকে প্রদান করেছি বারবার পঠিতব্য সাতটি আয়াত ও মহান কুরআন’ (হিজর ১৫/৮৭)।
১. নামকরণ :
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, সূরাটির নাম ‘উম্মুল কিতাব’ এজন্য রাখা হয়েছে যে, এই সূরার মাধ্যমেই পবিত্র কুরআনের সংকলন কার্য শুরু করা হয়েছে এবং এই সূরা পাঠের মাধ্যমে ছালাত শুরু করা হয়ে থাকে।[7] আরবরা প্রত্যেক বস্ত্তর উৎস, সারগর্ভ বস্ত্ত বা কোন কাজের অগ্রভাগ, যার অনুগামী শাখা-প্রশাখা সমূহ রয়েছে, তাকে ‘উম্ম’ (أُمٌّ) বলে। যেমন মক্কাকে উম্মুল ক্বোরা (أم القرى) বলা হয়, পৃথিবীর প্রথম ও শীর্ষ মর্যাদাবান নগরী হওয়ার কারণে এবং এটাই পৃথিবীর নাভিমূল ও এখান থেকেই পৃথিবী বিস্তৃতি লাভ করেছে’ (ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। অতএব সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন (أم القرأن) এজন্য বলা হয়েছে যে, এটা দিয়েই কুরআন শুরু হয়েছে এবং এর মধ্যে কুরআনের সমস্ত ইল্ম শামিল রয়েছে’ (কুরতুবী)।
সূরা ফাতিহার নাম সমূহ :
বিভিন্ন হাদীছ, আছার ও বিদ্বানগণের নামকরণের মাধ্যমে অন্যূন ৩০টি নাম বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে ছহীহ হাদীছসমূহে এসেছে ৮টি। যেমন : (১) উম্মুল কুরআন (কুরআনের মূল)। (২) উম্মুল কিতাব (কিতাবের মূল)। (৩) আস-সাব‘উল মাছানী (সাতটি বারবার পঠিতব্য আয়াত)। (৪) আল-কুরআনুল ‘আযীম (মহান কুরআন)।[8] (৫) আল-হামদু (যাবতীয় প্রশংসা)। (৬) ছালাত।[9] (৭) রুক্বিয়াহ (ফুঁকদান)।[10] (৮) ফাতিহাতুল কিতাব (কুরআনের মুখবন্ধ)।[11] এ নামে সকল বিদ্বান একমত। কারণ এ সূরা দিয়েই কুরআন পাঠ শুরু হয়। কুরআনুল কারীম লেখা শুরু হয় এবং এটা দিয়েই ছালাত শুরু হয় (কুরতুবী)।
এতদ্ব্যতীত অন্য নামগুলি যেমন : (৯) শিফা (আরোগ্য)[12], (১০) আসাসুল কুরআন (কুরআনের ভিত্তি)। ইবনু আববাস (রাঃ) এ নামকরণ করেছেন (ইবনু কাছীর)। (১১) কাফিয়াহ (যথেষ্ট)। ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর এ নামকরণ করেছেন। কারণ এটুকুতেই ছালাত যথেষ্ট এবং এটি ব্যতীত ছালাত হয় না (কুরতুবী)। (১২) ওয়াফিয়াহ (পূর্ণ)। সুফিয়ান বিন উয়ায়না এ নামকরণ করেছেন। কারণ এ সূরাটি সর্বদা পূর্ণভাবে পড়তে হয়। আধাআধি করে দু’রাক‘আতে পড়া যায় না (কুরতুবী)। (১৩) ওয়াক্বিয়াহ (হেফাযতকারী)। (১৪) কান্য (খনি)। এছাড়াও ফাতিহাতুল কুরআন, সূরাতুল হাম্দ, শুক্র, ফাতিহাহ, মিন্নাহ, দো‘আ, সওয়াল, মুনাজাত, তাফভীয, মাসআলাহ, রা-ক্বিয়াহ, নূর, আল-হাম্দুলিল্লাহ, ইল্মুল ইয়াক্বীন, সূরাতুল হাম্দিল ঊলা, সূরাতুল হাম্দিল কুছরা’। এইভাবে নাম বৃদ্ধির ফলে সূরা ফাতিহার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।[13]
প্রকাশ থাকে যে, পবিত্র কুরআনের সূরা সমূহের এক বা একাধিক নামকরণ, মাক্কী ও মাদানী সূরার আগে-পিছে সংযোজন ও আয়াত সমূহের বিন্যস্তকরণ সবকিছু ‘তাওক্বীফী’ অর্থাৎ আল্লাহর ‘অহি’ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট ও রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক সন্নিবেশিত, যা অপরিবর্তনীয়।[14] এর মধ্যে গূঢ় তত্ত্বসমূহ নিহিত রয়েছে।
অবতরণকাল :
সর্বপ্রথম সূরা ‘আলাক্ব-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত মক্কায় নাযিল হয়।[15] অতঃপর কয়েক দিন অহি-র বিরতিকাল শেষে সূরা মুদ্দাছ্ছির-এর প্রথম ৫টি আয়াত নাযিল হয়।[16] অন্য বর্ণনায় ৭টি আয়াতের কথা এসেছে।[17] তারপরে সর্বপ্রথম পূর্ণাংগ সূরা হিসাবে সূরা ফাতিহা নাযিল হয়।[18]
বিষয়বস্ত্ত :
সূরা ফাতিহার মূল বিষয়বস্ত্ত হ’ল দো‘আ বা প্রার্থনা। একারণেই এই সূরার অন্যতম নাম হ’ল ‘সূরাতুদ দু‘আ’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,أَفْضَلُ الذِّكْرِ لآ إِلَهَ إِلاَّ الله ُوَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ اَلْحَمْدُ ِللهِ ‘শ্রেষ্ঠ যিক্র হ’ল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বা সূরা ফাতিহা’।[19]এর দ্বারা একথাই বুঝানো হয়েছে যে, মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হ’তে ফায়েদা পেতে গেলে তাকে অবশ্যই উক্ত নিয়তে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করতে হবে। এই সূরাতে বর্ণিত মূল দো‘আ হ’ল ৫ম আয়াত, إِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ ‘তুমি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর’! বস্ত্ততঃ সমস্ত কুরআনই উক্ত প্রার্থনার বিস্তারিত জওয়াব।
দো‘আর আদব :
অত্র সূরাতে দো‘আ করার আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ১ম হ’তে ৩য় আয়াত পর্যন্ত যার নিকটে প্রার্থনা করা হবে, সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে। অতঃপর ৪র্থ আয়াতে তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা হয়েছে ও কেবলমাত্র তাঁর নিকট থেকেই সাহায্য কামনার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। অতঃপর ৫ম আয়াতে মূল দো‘আর বিষয়বস্ত্ত ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর হেদায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ ও ৭ম আয়াতদ্বয় মূলতঃ ৫ম আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে। এইভাবে প্রার্থনা নিবেদন শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে আল্লাহর নিকটে ‘আমীন’ বলে দো‘আ কবুলের আবেদন করতে বলেছেন। মোটকথা প্রথমে প্রশংসা ও আনুগত্য নিবেদন করার পরে দো‘আ পেশ করা হয়েছে। একইভাবে ছালাতের বাইরে আল্লাহর জন্য হাম্দ ও রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পেশ করার পরে দো‘আ করা হ’ল দো‘আর সুন্নাতী তরীকা।[20]
এই সূরাতে ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’-এর হেদায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে। আর এই হেদায়াত পাওয়ার উপরেই বান্দার ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি নির্ভর করে। সম্ভবতঃ একারণেই ছালাতের প্রতি রাক‘আতের শুরুতে ইমাম ও মুক্তাদী সকল মুছল্লীর জন্য জেহরী ও সের্রী সকল ছালাতে এই সূরা পাঠ করা ফরয করা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’।[21]সম্ভবতঃ একারণেই সূরায়ে ফাতিহার অন্যতম নাম হ’ল ‘ছালাত’। অর্থাৎ যা ব্যতীত ‘ছালাত’ সিদ্ধ হয় না। যদিও অনেক বিদ্বান ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করাকে অসিদ্ধ বলেন। অথচ এর পক্ষে ছহীহ হাদীছ থেকে কোন দলীল নেই। তাছাড়া ছালাতের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা বাদ দিয়ে কিভাবে উক্ত ছালাত ও ইবাদত কবুল হ’তে পারে?
ফাযায়েল :
(১) এই সূরা কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদামন্ডিত সূরা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তাওরাত, যবূর, ইনজীল এবং কুরআনে এই সূরার তুলনীয় কোন সূরা নেই।[22]
(২) এই সূরা এবং সূরায়ে বাক্বারাহর শেষ তিনটি আয়াত হ’ল আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত বিশেষ নূর, যা ইতিপূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি।[23]
গুরুত্ব :
যে ব্যক্তি ছালাতের মধ্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার ছালাত অপূর্ণাঙ্গ ও বিকলাঙ্গ (خِدَاجٌ)। আবু ওবায়েদ বলেন, ‘খিদাজ’ হ’ল গর্ভচ্যুত মৃত সন্তান যা কোন কাজে আসে না।[24] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ কথাটি তিনবার বলেন। রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, যখন আমরা ইমামের পিছনে থাকি? জওয়াবে তিনি বলেন, إِقْرَأْ بِهَا فِىْ نَفْسِكَ ‘তখন তুমি ওটা চুপে চুপে পড়’। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ বলেন, قَسَّمْتُ الصَّلاَةَ بَيْنِيْ وَ بَيْنَ عَبْدِىْ نِصْفَيْنِ. ‘ছালাতকে অর্থাৎ সূরা ফাতিহাকে আমি আমার ও আমার বান্দার মধ্যে দু’ভাগে ভাগ করেছি। আর আমার বান্দা যা চাইবে তাই পাবে। যখন সে বলে, আলহামদুলিল্লাহ..’ তখন আল্লাহ বলেন, حَمِدَنِىْ عَبْدِىْ ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে’। যখন সে বলে, ‘আর রহমা-নির রহীম’ তখন আল্লাহ বলেন, أَثْنَى عَلَىَّ عَبْدِىْ ‘আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে’। যখন সে বলে, ‘মা-লিকি....’ তখন আল্লাহ বলেন, مَجَّدَنِىْ عَبْدِىْ ‘বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করেছে’। যখন সে বলে, ইইয়াকা না‘বুদু.. তখন আল্লাহ বলেন, هَذَا بَيْنِىْ وَبَيْنَ عَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ ‘এটি আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বিভক্ত। আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে’। অতঃপর যখন সে বলে, ‘ইহ্দিনাছ ছিরাত্বাল ... ওয়াল লায্ যা-ল্লীন’ তখন আল্লাহ বলেন, هَذَا لِعَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ ‘এটি সম্পূর্ণ আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা যা চেয়েছে, তাই পাবে।[25] অত্র হাদীছে জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পাঠের স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। অতএব জেহরী বা সের্রী সকল ছালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয। ছাহাবীর ব্যাখ্যা পাওয়ার পরে অন্য কারু মতামতের প্রতি দৃকপাত করা ঠিক হবে না।
ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘এই সূরার নাম ‘ছালাত’ (الصلاة) বলা হয়েছে একারণে যে, ছালাতের জন্য এটি পাঠ করা সবচেয়ে বড় রুকন’ (ঐ, তাফসীর সূরা ফাতিহা)। তিনি বলেন, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এবং যেসকল বিদ্বান ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয বলেন না, তাদের প্রধান দলীল হ’ল, فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ‘তোমরা কুরআন থেকে যা সহজ হয়, ততটুকু পাঠ কর’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২০)। অথচ আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক বিবেচনায় জমহূর বিদ্বানগণের নিকট এখানে ‘কুরআন’ অর্থ ছালাত। অর্থাৎ তোমাদের পক্ষে যতটুকু সহজ হয়, ততটুকু রাত্রি জাগরণ কর। কুরআন তেলাওয়াত যেহেতু ছালাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেকারণে এখানে ‘কুরআন’ বলা হয়েছে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْدًا ‘নিশ্চয়ই ফজরের কুরআন অর্থাৎ ছালাত (দিবস বা রাত্রির বদলী ফেরেশতাদ্বয়ের) একত্রিত হওয়ার সময়কাল’ (ইসরা ১৭/৭৮; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুযযাম্মিল ২০)।
(২) উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (‘লা ছালা-তা লিমান লাম ইয়াক্বরা’ বিফা-তিহাতিল কিতা-ব’) ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না’।[26]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ تُجْزِئُ صَلاَةٌ لاَ يُقْرَأُ فِيْهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ‘ঐ ছালাত সিদ্ধ নয়, যাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা হয় না’...। [27]
(৪) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, একদা এক সফরে আমাদের এক সাথী জনৈক গোত্রপতিকে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিয়ে সাপের বিষ ঝাড়েন ও তিনি সুস্থ হন...।[28] এজন্য এ সূরাকে রাসূল (ছাঃ) ‘রুক্বইয়াহ’ (الرُّقْيَةُ) বলেছেন।[29] কেননা এই সূরা পড়ে ফুঁক দিলে আল্লাহর হুকুমে রোগী সুস্থ হয়ে যায়।
(৫) ইমাম কুরতুবী বলেন, সূরা ফাতিহাতে যে সকল ‘ছিফাত’ রয়েছে, তা অন্য কোথাও নেই। এমনকি একেই ‘আল-কুরআনুল আযীম’ বা মহান কুরআন বলা হয়েছে (হিজর ১৫/৮৭)।
এই সূরার ২৫টি কলেমা কুরআনের যাবতীয় ইল্মকে শামিল করে। এই সূরার বিশেষ মর্যাদা এই যে, আল্লাহ এটিকে নিজের ও নিজের বান্দার মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। একে বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। সেজন্যই একে ‘উম্মুল কুরআন’ বা ‘কুরআনের সারবস্ত্ত’ বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন মূলতঃ তিনটি বিষয়ে বিভক্ত। তাওহীদ, আহকাম ও নছীহত। সূরা ইখলাছে ‘তাওহীদ’ পূর্ণাঙ্গভাবে থাকার কারণে তা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু সূরা ফাতিহাতে তিনটি বিষয় একত্রে থাকার কারণে তা ‘উম্মুল কুরআন’ হওয়ার মহত্তম মর্যাদা লাভে ধন্য হয়েছে।[30]
ফায়েদা :
সূরা ফাতিহাকে অনেকে বিদ‘আতী কাজে ব্যবহার করেন, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন কবর যিয়ারতের সময় ফাতিহা পাঠ করা, বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপলক্ষে সূরা ফাতিহা পাঠ করা, নির্দিষ্ট সংখ্যক বার ফাতিহা পাঠ করে দো‘আ করা, খুৎবা, দো‘আ বা ওয়ায-নছীহতের শুরু বা শেষে সূরা ফাতিহা পাঠ করা, ফজরের আযানের পূর্বে বা পরে মাইকে সূরা ফাতিহা পাঠ করা, সম্মিলিত দো‘আর জন্য হাত উঠানোর পূর্বে সকলকে ফাতিহা পড়তে বলা, মজলিস শেষে ফাতিহা পাঠ, মৃতের পাশে বসে ফাতিহা পাঠ, কবরে মাথার দিকে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা ও পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে সূরা বাক্বারাহর শুরুর অংশ পড়া, দাফনের সময় সূরা ফাতিহা, ক্বদর, কাফিরূন, নছর, ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস এই সাতটি সূরা বিশেষভাবে পাঠ করা, কবরের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা ১ বার ও ইখলাছ ১১ বার অথবা সূরা ইয়াসীন ১ বার পাঠ করা ইত্যাদি। অথচ ছহীহ হাদীছসমূহে কঠোর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও অনেকে জেহরী বা সের্রী ছালাতে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করেন না। মনে রাখা আবশ্যক যে, দো‘আ হ’ল ইবাদত। যার নিয়ম-পদ্ধতি শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত। যা অপরিবর্তনীয়। এখানে খেয়াল-খুশীমত কোন কাজ করা যায় না। বড় কথা হ’ল এই যে, বিদ‘আতের মাধ্যমে কোন ইবাদত কবুল হয় না।
তাফসীর :
আঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পাঠ :
আল্লাহ বলেন, وَقُلْ رَبِّ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِيْنِ، وَأَعُوْذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَّحْضُرُوْنِ ‘তুমি বল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি শয়তানের প্ররোচনা হ’তে’। ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট ওদের উপস্থিতি হ’তে’ (মুমিনূন ২৩/৯৭-৯৮)। তিনি বলেন, وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে আল্লাহর আশ্রয় চাও। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (হা-মীম সাজদাহ/ফুছছিলাত ৪১/৩৬)। তিনি বলেন, فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ ‘যখন তুমি কুরআন পাঠ করবে, তখন অভিশপ্ত শয়তান হ’তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে’ (নাহল ১৬/৯৮)।
উপরোক্ত আয়াতসমূহের আলোকে বিদ্বানগণ বলেন, ছালাতের মধ্যে বা বাইরে কুরআন পাঠের শুরুতে শয়তানের ধোঁকা হ’তে আল্লাহর নিকটে পানাহ চেয়ে ‘আঊযুবিল্লাহ....’ পাঠ করা, অতঃপর আল্লাহর নামে ক্বিরাআত শুরু করার সংকল্প করে ‘বিসমিল্লাহ...’ পাঠ করা মুস্তাহাব।[31] ছালাতের শুরুতে ছানা বা দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ পাঠ শেষে আঊযুবিল্লাহ কেবল ১ম রাক‘আতে পড়বে, বাকী রাক‘আতগুলিতে নয়।[32] জেহরী ছালাতে ‘বিসমিল্লাহ...’ চুপে চুপে পড়ার দলীল অধিকতর স্পষ্ট ও মযবুত।[33] তবে যে সকল বিদ্বান বিসমিল্লাহ-কে সূরায়ে ফাতিহার অন্যতম আয়াত মনে করেন, তাঁরা জেহরী ছালাতে অন্য আয়াতের ন্যায় এটিকেও জোরে পড়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।[34] মূলতঃ ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ মক্কায় অবতীর্ণ সূরা নমল-এর ৩০ আয়াতের অংশ বিশেষ, যা সাবা-র রাণী বিলক্বীস-এর নিকটে লিখিত পত্রের শুরুতে হযরত সুলায়মান (আঃ) লিখেছিলেন।[35] এই আয়াত নাযিলের পূর্বে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখতেন। পরে ‘বিসমিল্লাহ’ লিখতে শুরু করেন। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন সূরার মধ্যে পার্থক্য বুঝানোর জন্য সূরা তওবা ব্যতীত অন্য সকল সূরার প্রথমে ‘বিসমিল্লাহ’ লিখিত ও পঠিত হয়। অমনিভাবে বই ও চিঠি-পত্রের শুরুতে বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা সম্পর্কে উম্মতের ঐক্যমত রয়েছে।[36]
বিসমিল্লাহর শুরুতে إسم বা নাম কথাটি বৃদ্ধি করা হয়েছে আল্লাহর মর্যাদা আরও সমুন্নত করার জন্য এবং যাতে ‘বিল্লাহ’ শব্দ দ্বারা কসম বা শপথ না বুঝায়, সেজন্য। অধিক ব্যবহারের কারণে باسم থেকে আলিফ বিলুপ্ত করে بسم করা হয়েছে। اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ তে আলিফ মওজুদ আছে অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহারের কারণে।
اَللهُ হ’ল বিশ্বপ্রভুর সত্তাগত নাম বা ‘ইসমে আ‘যম’ (الإسم الأعظم)। বাকী নামসমূহ এর অনুগামী ও গুণবাচক নাম। বিশ্বপ্রভুর সত্তা ব্যতীত ‘আল্লাহ’ নাম অন্য কারু জন্য প্রযোজ্য নয়। আরবী বা অন্য কোন ভাষায় এই নামের কোন প্রতিশব্দ নেই। অতএব আল্লাহ-এর বদলে খোদা, ঈশ্বর, ভগবান, গড, উপরওয়ালা ইত্যাদি বলা যাবে না। ‘আল্লাহ’ নামের কোন স্ত্রীলিঙ্গ, দ্বিবচন বা বহুবচন নেই। উলূহিয়াতের সকল গুণাবলীর ধারক হ’লেন আল্লাহ। তিনিই একমাত্র মা‘বূদ। তিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব চরাচরের ধারক।
أَلَهَ يَلَهُ إِلَهَةً أُلُوْهِيَّةً অর্থ উপাসনা করা। সেখান থেকে مَأْلُوْهٌ অর্থ مَعْبُوْدٌ উপাস্য। অধিকাংশ বিদ্বানের মতে ‘আল্লাহ’ শব্দটি ‘মুশতাক্ব’, যা إِلاَهٌ মাদ্দাহ হ’তে উদ্গত। ওযন فِعَالٌ। إِلاَهٌ -এর উপরে اَلْ প্রবেশ করানোর পর (اَلْإِلَهُ) হালকা করার জন্য ‘হামযাহ’ ফেলে দিয়ে اَللهُ করা হয়েছে ‘সম্মান’ বুঝানোর জন্য। উক্ত اَلْ সর্বদা আবশ্যিক থাকবে। কখনোই পৃথক করা যাবে না। যাহহাক বলেন, إِنَّمَا سُمِّىَ اللهُ إِلٰهًا لان الخلق يتألَّهُوْن إليه فى حوائجهم ‘আল্লাহ’-কে ‘ইলাহ’ এজন্য বলা হয়েছে যে, সৃষ্টিকুল স্ব স্ব প্রয়োজনে হয়রান ও নিরাশ হয়ে তাঁর কাছেই উপনীত হয় (কুরতুবী ১/১৩৯-৪০)।
ফায়েদা :
আজকাল আরবীতে আললাহ (الله) লিখে তা বিভিন্ন মসজিদে, গাড়ীর মাথায়, বাড়ীতে ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত ও চরম বেআদবীও বটে। অনেকে একপাশে আরবীতে ‘আল্লাহ’ (الله) অন্যপাশে ‘মুহাম্মাদ’ (محمد) লিখেন। যার মাধ্যমে উভয়কে মর্যাদার দিক থেকে সমান গণ্য করা হয় এবং বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে এগুলি করা হয়। অথচ শরী‘আতে এর কোন দলীল নেই। এগুলি শয়তানী ধোঁকা ব্যতীত কিছু নয়। এসব থেকে তওবা না করে মারা গেলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
رَحْمٰنٌ ‘রহমান’ ও ‘রহীম’ দু’টিই ‘মুশতাক্ব’ যা রহম (الرَّحْمَةُ) মাদ্দাহ হ’তে উদ্গত। অর্থ দয়া, অনুগ্রহ। ‘রহমান’ দ্বারা রহম বা অনুগ্রহের আধিক্য বুঝানো হয়েছে, যা সকল ধরনের অনুগ্রহকে শামিল করে। এটি আল্লাহর জন্য খাছ। এই বিশেষণ অন্যের জন্য সিদ্ধ নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, قُلِ ادْعُوا اللهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَّا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى ‘তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহবান কর বা ‘রহমান’ নামে আহবান কর, যে নামেই তোমরা ডাক, তাঁর সব নামই সুন্দর’ (ইসরা ১৭/১১০)। এখানে ‘রহমান’কে আল্লাহ নামের সমান গণ্য করা হয়েছে, যার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। অন্যত্র তিনি বলেন,وَاسْأَلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُسُلِنَا أَجَعَلْنَا مِنْ دُوْنِ الرَّحْمٰنِ آلِهَةً يُعْبَدُوْنَ ‘ তোমার পূর্বে আমরা যেসব রাসূল প্রেরণ করেছিলাম, তাদেরকে তুমি জিজ্ঞেস কর আমরা কি ‘রহমান’ (আল্লাহ) ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নির্ধারণ করেছিলাম, যাদের ইবাদত করা যায়? (যুখরুফ ৪৩/৪৫)। এখানে আল্লাহকে ‘রহমান’ বলা হয়েছে।
رَحِيْمٌ আল্লাহ ও বান্দা সবার জন্য বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছিফাত হিসাবে পবিত্র কুরআনে رَؤُوْفٌ رَحِيْمٌ বিশেষণ দু’টি ব্যবহৃত হয়েছে (তওবা ৯/১২৮)। তাছাড়া আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহশীল বুঝানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয়েছে, وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَحِيْمًا ‘নিশ্চয়ই তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু’ (আহযাব ৩৩/৪৩)।
দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর অনুগ্রহের ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য দু’টো একই গুণবাচক শব্দকে একই স্থানে একত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধকে পরাভূত করে[37] إنَّ رَحْمَتىْ سَبَقَتْ غَضَبِىْ (متفق عليه) এবং তাঁর রহমত সকল কিছুতেই ব্যাপ্ত রয়েছে رَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ (আ‘রাফ ৭/১৫৬)।
বিভিন্ন শুভ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে বহু হাদীছ এসেছে। ‘বিসমিল্লাহ’ হ’ল দুষ্ট জিন ও মানুষের লজ্জাস্থানের পর্দা স্বরূপ।[38] গৃহে প্রবেশ করা ও বের হওয়া, বাড়ীর দরজা বন্ধ করা, বাতি নেভানো, পাত্র ঢাকা, বোতলের মুখ লাগানো, চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করা, ওযূ-গোসল, খানা-পিনা, যবহ ইত্যাদি সকল শুভ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার জন্য হাদীছে স্পষ্টভাবে নির্দেশ এসেছে। শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে بِسْمِ اللهِ أَوَّلَهُ وآخِرَهُ বলতে হবে।[39] কিন্তু যেসকল ইবাদতের পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার বিধান নেই, সেসবের শুরুতে তা বলা যাবে না। যেমন আযান, ইক্বামত, ছালাত প্রভৃতির শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা। ওছমান বিন আবুল ‘আছ ইসলাম গ্রহণের পর থেকে ব্যথার অসুখে আক্রান্ত ছিলেন। রাসূলুললাহ (ছাঃ) তাঁকে ব্যথার স্থানে হাত রেখে তিনবার ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ও সাত বার أَعُوْذُ بِعِزَّةِ اللهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ পাঠ করতে আদেশ দিলেন এবং তাতে তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন’।[40]
সকল শুভ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার মধ্যে তাকদীরকে অস্বীকারকারী ভ্রান্ত ফিরকা ‘ক্বাদারিয়া’ ও তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রয়েছে। কেননা তাদের ধারণা মতে বান্দার কাজ তার নিজ ইচ্ছাধীন। এখানে আল্লাহর ইচ্ছার কোন প্রতিফলন নেই। অথচ আল্লাহ পাক আমাদেরকে সকল কাজের শুরুতে আল্লাহর সাহায্য ও তাওফীক কামনার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত বান্দার কোন ইচ্ছাই পূরণ হ’তে পারে না। তিনিই কর্মের স্রষ্টা ও বান্দা কর্মের বাস্তবায়নকারী মাত্র। তাছাড়া শুধুমাত্র আমল কাউকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না, যদি না আল্লাহর রহমত থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يُدْخِلُ أحدًا منكم عملُه الجنةَ وَلاَ يُجِيْرُهُ مِنَ النَّارِ وَلاَ أَنَا إِلاَّ بِرَحْمَةِ اللهِ ‘কারু আমল তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে না কিংবা জাহান্নাম থেকে রেহাই দেবে না, এমনকি আমাকেও নয়, আল্লাহর রহমত ব্যতীত’।[41] তাই শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠের মাধ্যমে মূলতঃ আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ কামনা করা হয়।
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ : ‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’। এতে ৪টি শব্দ ও ১৯টি বর্ণ রয়েছে। বাক্যের প্রথমে اِبْتَدَأْتُ অর্থাৎ ‘আমি শুরু করছি’ ক্রিয়াটি উহ্য রয়েছে। ‘বিসমিল্লাহ’ অর্থ আল্লাহর নামের সাথে, তাঁর নামের সাহায্যে ও তাঁর নামের বরকতে। বিসমিল্লাহ বলার সময় উহ্য ক্রিয়াটির নিয়ত করতে হবে। নইলে ওটা কেবল পাঠ করাই সার হবে। যেমন বিসমিল্লাহি আক্বরাউ (আল্লাহর নামে আমি পড়া শুরু করছি)। বিসমিল্লাহি আ-কুলু (আল্লাহর নামে আমি খেতে শুরু করছি) ইত্যাদি। আরবী বা বাংলায় মুখে নিয়ত পড়া বিদ‘আত। বরং হৃদয়ে আল্লাহর নামে উক্ত শুভ কাজের সংকল্প করতে হবে।
এখানে ক্রিয়াপদকে উহ্য রাখার কারণ হ’তে পারে দু’টি : (১) শুরুতেই আল্লাহ নামের বরকত হাছিল করা (২) অন্য কারু সাহায্যে নয়, কেবল আল্লাহর সাহায্যে আমি কর্ম শুরু করছি, সেটা বুঝানো। এটি সূরা নমলের ৩০ আয়াত। কিন্তু এ আয়াতটিকে পবিত্র কুরআনের সূরা সমূহের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে প্রত্যেক সূরার শুরুতে রাখা হয়েছে। কেবল সূরা তওবার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ রাখা হয়নি। এর রহস্য আল্লাহ ভাল জানেন। যদিও ড. আহমাদ দীদাত (১৯১৮-২০০৫ খৃঃ) ও অনেকে এর মাধ্যমে ১৯ সংখ্যার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে চেয়েছেন। কারণ সেটা থাকলে সূরা নমলের ৩০ আয়াতের বিসমিল্লাহ সহ কুরআনে ১১৫টি বিসমিল্লাহ হবে। যা ১৯ দিয়ে গুণ করলে মিলত না।
যুগে যুগে বিজ্ঞান যত এগিয়ে যাবে, কুরআনের বিভিন্ন অলৌকিক বিষয় তেমনি মানুষের সামনে খুলে যাবে। তবে সাবধান থাকতে হবে যেন এর দ্বারা কোন ভ্রান্ত আক্বীদা জন্ম না নেয়। যেমন ইরানের বাহাঈরা ইতিমধ্যে ১৯ তত্ত্বে বাড়াবাড়ি করে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। উল্লেখ্য যে, বাহাঈ ইরানের একটি কাফির ধর্মীয় সম্প্রদায়। খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভাব হওয়ায় এরা ১৯ সংখ্যাকে পবিত্র মনে করে। এই ধর্মের মতে ১৯ দিনে মাস হয়, ১৯ মাসে বছর হয়। রামাযানের ছিয়াম ১৯ দিন রাখতে হয় এবং সম্পদের যাকাত ১৯ শতাংশ দিতে হয়। তালাক ১৯ বার দেওয়া যায়। তাদের ধর্মগ্রন্থ আল-বায়ানের (البيان العربى) অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১৯। তারা এটিকে কুরআনের রহিতকারী (ناسخ) মনে করে। কুরআনকে বাহাঈ ধর্মের সত্যতার পক্ষে ব্যবহার করার জন্য কিছু লোক কুরআনের সূরা, আয়াত, শব্দ, বর্ণ সবকিছুকে ১৯ দিয়ে মিলাতে গলদঘর্ম হয়েছেন। অথচ এই গণনা ইতিমধ্যেই বাতিল প্রমাণিত হয়েছে। জনৈক মিসরীয় ড. রাশাদ খলীফা (১৯৩৫-১৯৯৩ খৃঃ) একাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে অবশেষে নাস্তিক হয়েছেন ও নিহত হয়েছেন।
আল্লাহ বলেন, عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ ‘জাহান্নামের প্রহরী হ’ল ১৯ জন ফেরেশতা’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৩০)। এই আয়াতকে তারা তাদের ১৯ তত্ত্বের পক্ষে ব্যবহার করেছেন। অথচ পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে,
وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلاَّ مَلاَئِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلاَّ فِتْنَةً لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِيْمَانًا وَلاَ يَرْتَابَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَلِيَقُوْلَ الَّذِيْنَ فِي قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ وَالْكَافِرُوْنَ مَاذَا أَرَادَ اللهُ بِهَذَا مَثَلاً-
‘আমরা ফেরেশতাদের এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছি কাফেরদের পরীক্ষা করার জন্য। যাতে কিতাবীরা (রাসূলের সত্যতার ব্যাপারে) দৃঢ় বিশ্বাসী হয়, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং কিতাবীরা ও মুমিনগণ সন্দেহ পোষণ না করে এবং যাতে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে (মুনাফিকরা) ও কাফেররা বলে যে, এর (এই সংখ্যা) দ্বারা আল্লাহ কি বুঝাতে চেয়েছেন’? (মুদ্দাছছির ৭৪/৩১)। সেযুগে বোকা আবু জাহল এর ব্যাখ্যা বুঝতে না পেরে ফেৎনায় পড়ে তার লোকদের বলেছিল, ‘হে কুরায়েশ যুবকেরা! তোমাদের ১০ জনে কি জাহান্নামের ১ জন ফেরেশতাকে কাবু করতে পারবে না? (ইবনু কাছীর)। এ যুগের কাফের বাহাঈ ও তাদের যুক্তিতে বিমোহিত ব্যাধিগ্রস্ত ঈমানদাররাও এ আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝতে না পেরে ফিৎনায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
মনে রাখতে হবে যে, বিশুদ্ধ আক্বীদা কেবল সেটাই, যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল। তাঁদের যুগে যেটি ‘দ্বীন’ বলে গৃহীত ছিল না, এযুগেও সেটা দ্বীন হিসাবে গৃহীত হবে না।
আরবের মুশরিকরা সকল কাজের শুরুতে তাদের দেব-দেবীর নাম নিত। যেমন ‘বিসমিল্লা-তে ওয়াল ওযযা’ (লাত ও ওযযার নামে)। তার প্রতিবাদে কুরআনের প্রথম আয়াত নাযিল হয় ‘ইক্বরা বিসমে রবিবকাল্লাযী খালাক্বা’ বলে। অর্থাৎ ‘তুমি পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। পরবর্তীতে সকল শুভ কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার সুন্নাত জারি হয় এবং আল্লাহর হুকুমে কুরআনের প্রত্যেক সূরার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা হয়। তবে কুরআন পাঠ করার সময় প্রথমে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে ‘আঊযুবিল্লাহ’ পাঠ করতে হয় (নাহল ১৬/৯৮)। তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তে হয়। ছালাতের প্রথম রাক‘আতে ক্বিরাআতের শুরুতে আঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ এবং পরের রাক‘আতগুলিতে স্রেফ বিসমিল্লাহ পড়তে হয়। اَلرَّحْمَنُ নামটি আরবদের নিকটে নতুন ছিল। اَلرَّحْمَنُ ও اَلرَّحِيْمُ দু’টি শব্দের একই অর্থ হ’লেও রহমান-এর মধ্যে দয়াগুণের আধিক্য ও ব্যাপ্তি সর্বাধিক।
বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ কি-না :
একদল বিদ্বান একে সূরা ফাতিহার অংশ বলেন এবং জেহরী ছালাতে বিসমিল্লাহ সরবে পড়েন। আরেকদল বিদ্বান একে সূরা ফাতিহার অংশ বলেন না এবং জেহরী ছালাতে এটি নীরবে পাঠ করেন। শেষোক্ত বিদ্বানগণের বক্তব্যই সঠিক। কেননা বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ হওয়ার কোন ছহীহ দলীল নেই। ইতিপূর্বে আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত ছহীহ মুসলিম-এর হাদীছটিতে সূরা ফাতিহাকে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে যে ভাগ করা হয়েছে,[42] সেখানে বিসমিল্লাহর কোন উল্লেখ নেই। বস্ত্ততঃ কুরআনের সকল আয়াতই মুতাওয়াতির। কোন আয়াতেই কোন মতভেদ নেই। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, বিসমিল্লাহসূরা ফাতিহার অংশ না হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এতে মতভেদ রয়েছে। অথচ কুরআনে কোন মতভেদ নেই’। বরং এটি সূরা নমলের একটি আয়াত মাত্র, যা দুই সূরার মধ্যে পার্থক্যকারী হিসাবে পঠিত হয়।[43]
হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ), আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর পিছনে ছালাত আদায় করেছি। তাঁরা সর্বদা আলহামদু লিল্লাহি রবিবল ‘আলামীন দিয়েই ক্বিরাআত শুরু করতেন। ক্বিরাআতের শুরুতে বা শেষে তাঁদেরকে কখনো সরবে বিসমিল্লাহ পড়তে শুনিনি’।[44] তাছাড়া সূরা ফাতিহার সাতটি আয়াত গণনা করলে দেখা যায় যে, প্রথম আলহামদু ... আল্লাহর জন্য, দ্বিতীয় আররহমান ...আল্লাহর জন্য, তৃতীয় মা-লিকি ... আল্লাহর জন্য। চতুর্থ অর্থাৎ মাঝেরটি দু’ভাগ। প্রথম ভাগে ইইয়াকা না‘বুদু ... আল্লাহর জন্য এবং দ্বিতীয় ভাগে ... নাস্তাঈন বান্দার জন্য। পঞ্চম ইহদিনাছ ... বান্দার জন্য। ষষ্ঠ ছিরাত্বাল ... বান্দার জন্য এবং সপ্তম গায়রিলমাগযূবে ... বান্দার জন্য। এভাবে প্রতিটি আয়াতের পরিধিও সমান সমান। লম্বা-ছোট নয়। প্রথম তিনটি আয়াত আল্লাহর জন্য। শেষের তিনটি আয়াত বান্দার জন্য এবং মাঝের চতুর্থ আয়াতটি আল্লাহ ও বান্দার জন্য। অতএব এটাই সঠিক কথা যে, বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ নয়, যেমন তা অন্যান্য সূরার অংশ নয়।
(১) اَلْحَمْدُ ِللهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ - اَلْ অর্থ ‘যাবতীয়’ حَمْدُ ‘প্রশংসা’ ِللهِ ‘আল্লাহর জন্য’ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ‘জগতসমূহের প্রতিপালক’। রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) اَلْحَمْدُ -এর অর্থ করেছেন الشُّكْرُ ِللهِ ‘সকল কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য’। ইবনু জারীর ত্বাবারীও অনুরূপ অর্থ ব্যক্ত করেছেন। যদিও ‘হাম্দ’ অর্থ মৌখিক প্রশংসা এবং ‘শুক্র’ অর্থ কোন কিছুর বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, যা হবে ভালোবাসাপূর্ণ। কেননা ভালোবাসাহীন মৌখিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোন মূল্য নেই। اَلْحَمْدُ ِللهِِ সবকিছুকেই শামিল করে। কেননা اَلْএখানে استغراق বা সামগ্রিক অর্থে এসেছে। যা দ্বারা সকল প্রকারের প্রশংসা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাকে বুঝানো হয় এবং যা الثناء الكامل বা পূর্ণাঙ্গ প্রশংসা অর্থ প্রকাশ করে। এজন্যেই দেখা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুশীর সময় বলতেন, الْحَمْدُ ِللهِ الَّذِى بِنِعْمَتِهِ تَتِمُّ الصَّالِحَاتُ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যার অনুগ্রহে সকল শুভ কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে’। আবার কষ্টের সময় বলতেন الْحَمْدُ ِللهِ عَلَى كُلِّ حَالٍ ‘সর্বাবস্থায় আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা’।[45]
আমাদের পালনকর্তা আমাদেরকে যে অগণিত নে‘মত দান করেছেন, তার বিনিময়ে পূর্ণ কৃতজ্ঞতাসহ যাবতীয় প্রশংসা নিবেদন করাই এর উদ্দেশ্য। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَفْضَلُ الدُّعَاءِ اَلْحَمْدُ ِللهِ ‘শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল ‘আলহামদুলিল্লাহ’।[46] রব ও রহমান-এর পূর্বে ‘আল্লাহ’ নাম আনার মধ্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ‘আল্লাহ’ নামটিই হ’ল মূল। বাকী সব নামই তার অনুগামী।
رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘রব’ অর্থ প্রতিপালক, প্রভু, মনিব ইত্যাদি। আল্লাহর সকল গুণের মধ্যে প্রতিপালকের গুণই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ‘সৃষ্টিকর্তা’ হিসাবে তাঁকে প্রায় সকল মানুষ স্বীকার করলেও ‘পালনকর্তা’ হিসাবে অনেকে স্বীকার করতে চায় না। তাই মুমিন হওয়ার আবশ্যিক শর্ত হ’ল আল্লাহকে ‘রব’ হিসাবে স্বীকার করা। শুধুমাত্র ‘খালেক্ব’ বা সৃষ্টিকর্তা হিসাবে স্বীকার করা নয়। শুধু رَبٌّ বা الرَّبُّ বললে কেবলমাত্র আল্লাহকে বুঝাবে। অন্যের জন্য এই বিশেষণ প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ। তবে অন্যকিছুর দিকে সম্বন্ধ করলে সিদ্ধ হবে। যেমন رَبُّ هَذَا الْبَيْتِ ‘এই গৃহের মালিক’ رَبَّةُ الْبَيْتِ ‘গৃহকত্রী’ ইত্যাদি।
-عَالَمِيْنَ عَالَمٌ শব্দের বহুবচন। এর দ্বারা আল্লাহ ব্যতীত সকল অস্তিত্বশীল বস্ত্তকে বুঝানো হয়। عَالَمٌ নিজেই বহুবচন। এর কোন একবচন নেই। عَالَمِيْنَ বহুবচনের বহুবচন। এর দ্বারা মানুষের জানা-অজানা সকল সৃষ্টি জগতকে বুঝানো হয়েছে। ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ বলেন, আল্লাহ পাকের আঠারো হাযার মাখলূক্বাত রয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, চল্লিশ হাযার (ইবনু কাছীর)। মূলতঃ এর অর্থ অগণিত। পৃথিবী তার মধ্যে একটি। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ আসমান ও যমীন এবং এ দুইয়ের মধ্যকার ও মধ্যবর্তী আমাদের জানা ও অজানা অগণিত জগতের প্রভু ও প্রতিপালক’ (ইবনু কাছীর ১/২৫)। আধুনিক মহাকাশ গবেষণা যতই এগিয়ে যাচ্ছে, ততই আমাদের নিকটে নভোমন্ডলের নতুন নতুন বিস্ময়ের দুয়ার খুলে যাচ্ছে ও সূরা ফাতিহার এই বাণী কার্যকর হচ্ছে। সাথে সাথে আল্লাহ পাকের রুবূবিয়াতের ব্যাপকতর ধারণা মুসলিম-অমুসলিম সকলের মধ্যে ক্রমেই দৃঢ় হ’তে দৃঢ়তর হচ্ছে।
বিগত যুগেও এর প্রমাণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,قَالَ فِرْعَوْنُ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ قَالَ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِنْ كُنْتُمْ مُوقِنِينَ- ‘ফেরাঊন বলল, জগতসমূহের প্রতিপালক আবার কে? জবাবে মূসা বলল, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর যিনি প্রতিপালক। যদি তোমরা দৃঢ় বিশ্বাসী হও’ (শো‘আরা ২৬/২৩-২৪)। গর্বোদ্ধত ফেরাঊন একথা মানেনি। কিন্তু প্রকাশ্যে মেনে নিয়ে জীবন দিয়েছিল তার জাদুকরগণ (শো‘আরা ২৬/৪৭-৪৮)। একইভাবে মেনেছে যুগে যুগে প্রায় সকল মানুষ। সূরা ফাতিহার অত্র আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর একক পালনকর্তা হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর একত্ববাদ বা তাওহীদে রুবূবিয়াত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে رَبِّ الْعَالَمِيْنَ বলার মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের সবকিছুর উপরে আল্লাহর রুবূবিয়াতের ব্যাপকতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। عَالَمٌশব্দটি উদ্গত হয়েছে ‘আলামত’ (عَلاَمَةٌ) থেকে। যার অর্থ ‘নিদর্শন’। বস্ত্ততঃ বিশ্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিদর্শন পরিস্ফূট রয়েছে। কবি আব্দুললাহ ইবনুল মু‘তায (২৪৭-২৯৬ হিঃ) তাই বলেন,
فَيَا عَجَبًا كَيْفَ يُعْصَى الْإِلٰهُ + أَمْ كَيْفَ يَجْحَدُهُ الْجَاحِدُ
وَفِي كُلِّ شَيْءٍ لَهُ آيَةٌ + تَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ وَاحِدُ
‘আশ্চর্যের কথা! কিভাবে আল্লাহর অবাধ্যতা করা হয়? অথবা কিভাবে অস্বীকারকারী তাঁকে অস্বীকার করে’? ‘অথচ প্রত্যেক বস্ত্ততেই রয়েছে তাঁর নিদর্শন। যা প্রমাণ করে যে, তিনি এক’।
(২) الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ ‘যিনি করুণাময় কৃপানিধান’।
‘রহমান ও রহীম’ এর আলোচনা ‘বিসমিল্লাহ্’র ব্যাখ্যায় ইতিপূর্বে করা হয়েছে। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, পূর্বের আয়াতে ‘রববুল আলামীন’ বলে আল্লাহ যে ‘তারহীব’ বা ভীতিকর বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন, পরবর্তী আয়াতে ‘রহমান ও রহীম’ বলে স্বীয় ‘দয়া’ গুণের প্রকাশ ঘটিয়ে উভয় গুণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন ও মুমিনকে আল্লাহর রহমত হ’তে নিরাশ না হওয়ার জন্য ‘তারগীব’ বা উৎসাহ দান করেছেন। যেমন তারগীব ও তারহীব তিনি একই স্থানে ব্যক্ত করেছেন সূরা হিজ্র ৪৫-৫৯ আয়াতে ও সূরা মুমিন ৩ আয়াতে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,لَوْ يَعْلَمُ الْمُؤْمِنُ مَا عِنْدَ اللهِ مِنَ الْعُقُوبَةِ مَا طَمِعَ بِجَنَّتِهِ أَحَدٌ، وَلَوْ يَعْلَمُ الْكَافِرُ مَا عِنْدَ اللهِ مِنَ الرَّحْمَةِ مَا قَنِطَ مِنْ جَنَّتِهِ أَحَدٌ ‘যদি মুমিন ব্যক্তি জানতো আল্লাহর নিকটে কত কঠোরতম শাস্তি রয়েছে, তাহ’লে কেউই জান্নাতের আকাংখী হ’ত না। অনুরূপভাবে যদি কোন কাফির জানতো আল্লাহর নিকটে কি অপার অনুগ্রহ রয়েছে, তাহ’লে কেউই জান্নাত হ’তে নিরাশ হ’ত না’।[47] তিনি বলেন, আল্লাহ তাঁর নিকটে রক্ষিত রহমতের একশ ভাগের এক ভাগ দুনিয়াতে নাযিল করেছেন। যা তিনি জিন, ইনসান, পশু-পক্ষী ও কীট-পতঙ্গ সবকিছুর মধ্যে বণ্টন করেছেন। যা থেকেই তারা পরস্পরকে ভালবাসে ও পরস্পরের প্রতি দয়া করে। আর সেখান থেকেই জীবজন্তু তাদের বাচ্চাদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করে। বাকী নিরানববই ভাগ রহমত আল্লাহ রেখে দিয়েছেন, যা তিনি ক্বিয়ামতের দিন বিতরণ করবেন’।[48] সালমান ফারেসী (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এই রহমত বিতরণের মাধ্যমে ক্বিয়ামতের দিন তাঁর রহমত পরিপূর্ণতা লাভ করবে’।[49] আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে আরেক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যখন আল্লাহ সৃষ্টিকর্ম শেষ করেন, তখন আরশের উপর রক্ষিত কিতাবে তিনি লিখে দেন, إِنَّ رَحْمَتِى سَبَقَتْ غَضَبِى ‘নিশ্চয়ই আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর জয়লাভ করে’।[50] অত্র সূরায় নিজেকে ‘রববুল আলামীন’ বলার পরে ‘রহমান ও রহীম’ বলার মধ্যে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর এই রুবূবিয়াত বান্দার উপর প্রতিশোধের জন্য নয়, বরং রহমতের জন্য।
(৩) مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ ‘যিনি বিচার দিবসের মালিক’।
অত্র আয়াতে مَالِكِ ও সূরা নাসে مَلِكِ বলা হয়েছে। مَالِكِ শব্দটির অর্থ অধিকতর ব্যাপক। مَلِكِ النَّاسِ বলে কেবল ‘মানুষের অধিপতি’ বলা হয়েছে। কিন্তু مَالِكِ বলে এখানে সৃষ্টিকুলের অধিপতি বুঝানো হয়েছে। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ স্বীয় বান্দাদেরকে একথা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সৃষ্টি জগতের আদি হ’তে অন্ত পর্যন্ত সকল কিছুর চিরন্তন মালিকানা তাঁর হাতে। শাসক যেমন অধীনস্তদের নিয়োগ দান করেন ও তাদেরকে শাসকের নিকটে দায়বদ্ধ থাকতে হয়, অমনিভাবে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে বান্দাকে তিনি বিশ্বপরিচালনার বিভিন্ন পর্যায়ে সাময়িকভাবে দায়িত্ব প্রদান করেছেন। বান্দার কর্মজীবনের ছোট-বড় সবকিছুই আল্লাহর গোচরে রয়েছে এবং ক্বিয়ামতের দিন সবকিছুর চূড়ান্ত হিসাব তিনি গ্রহণ করবেন ও সে অনুযায়ী জাহান্নামের শাস্তি অথবা জান্নাতের পুরস্কার দান করবেন। তিনি ইচ্ছা করলে কোন বান্দাকে বিনা হিসাবেও জান্নাত দিতে পারেন। ফলতঃ বিচার দিবসের পূর্ণ মালিকানা ও একচ্ছত্র অধিকার কেবলমাত্র তাঁরই হাতে। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ তাঁর নিকটে সুফারিশ করতে পারবে না। তাঁর অনুগ্রহ ব্যতীত কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না।
الدِّيْنِ -এর অনেকগুলি অর্থ রয়েছে। যেমন প্রতিদান, হিসাব, ফায়ছালা, আনুগত্য, রীতি, আচরণ ইত্যাদি। এখানে يَوْمِ الدِّيْنِ -এর অর্থ يَوْمُ الْجَزَاءِ অর্থাৎ প্রতিদান বা হিসাব-এর দিন। যেমন বলা হয়ে থাকে, كَمَا تَدِيْنُ تُدَانُ ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’।
মানুষের দুনিয়াবী জীবনের যাবতীয় আমলের হিসাব ও তার প্রতিদান ও প্রতিফল ঐদিন আল্লাহ তাঁর বান্দাকে প্রদান করবেন। ২য় আয়াতে নিজেকে ‘করুণাময় ও কৃপানিধান’ ঘোষণা করার পরেই নিজেকে বিচার দিবস-এর মালিক ঘোষণা করে আল্লাহপাক এটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, পাপীকে ক্ষমা করার মধ্যে কোন করুণা নেই। বরং প্রকৃত করুণা নিহিত রয়েছে ন্যায়বিচারের মধ্যে। অতএব সকলে যেন চূড়ান্ত হিসাব দানের পূর্বে নিজ নিজ কর্মকে সুন্দর করে নেয়। কেননা সামান্যতম নেকী ও বদীর হিসাব ঐদিন নেওয়া হবে এবং সকলকে যথাযথভাবে প্রতিদান দেওয়া হবে। সেদিকে ইংগিত করে আল্লাহ বলেন, يَوْمَئِذٍ يُّوَفِّيْهِمُ اللهُ دِيْنَهُمُ الْحَقَّ ‘যেদিন আল্লাহ তাদেরকে যথার্থ প্রতিদান পরিপূর্ণরূপে দান করবেন’ (নূর ২৪/২৫)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُوْنَ لاَ تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ ‘সেই দিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে, যেদিন তোমাদের কোন গোপন বিষয় গোপন থাকবে না’ (আল-হাক্কাহ ৬৯/১৮)। তিনি বলেন, وَاتَّقُوْا يَوْمًا تُرْجَعُوْنَ فِيْهِ إِلَى اللهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُوْنَ ‘তোমরা সেইদিনকে ভয় কর, যেদিন তোমরা সকলে প্রত্যাবর্তিত হবে আল্লাহর নিকটে। অতঃপর প্রত্যেকে পুরোপুরি বদলা পাবে যা তারা অর্জন করেছিল এবং তারা অত্যাচারিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১)। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৭ অথবা ২১ দিন পূর্বে নাযিল হওয়া এটাই কুরআনের সর্বশেষ আয়াত।
(৪) إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ ‘আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’।
এখানে ক্রিয়া-র পূর্বে ‘কর্ম’ (مفعول به) আনা হয়েছে বিষয়টিকে নির্দিষ্টকরণের জন্য (لإفادة الحصر)। আর إِيَّاكَ (ضميرمنصوب منفصل) অর্থ ‘তোমাকেই’। অর্থাৎ আমরা কেবল তোমাকেই ইবাদতের জন্য ও সাহায্য প্রার্থনার জন্য খাছ করছি। তুমি ব্যতীত অন্য কারু ইবাদত করি না এবং অন্য কারো নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করি না। আভিধানিক অর্থে الْعِبَادَةُ فِى اللُّغَةِ غَايَةُ التَّذَلُّلِ وَالْخُضُوْعِ ‘চরম আনুগত্য ও প্রণতি’কে ইবাদত বা উপাসনা বলা হয়। শারঈ পরিভাষায় وَفِى الشَّرْعِ الْعِبَادَةُ تَتَضَمَّنُ كَمَال الذُّل بِكَمَالِ الْحُبِّ وَالْخَوْفِ للهِ بِاِمْتِثَالِ أَوَامِرِهِ وَاجْتِنَابِ نَوَاهِيْهِ‘আল্লাহর আদেশ পালন ও নিষেধ বর্জনের মাধ্যমে তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ ভালবাসা, ভীতি ও আনুগত্য পোষণ করা’কে ইবাদত বলা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আয়াতের অর্থ إِياَّكَ نُوَحِّدُ ‘আমরা কেবল তোমারই একত্ব ঘোষণা করি’ তোমাকেই মাত্র ভয় করি এবং তোমার আনুগত্য করার জন্যই তোমার সাহায্য প্রার্থনা করি।
‘তোমার ইবাদত করি’ একথাটুকু বুঝানোর জন্য نَعْبُدُكُ বলাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু كَকর্মপদের সর্বনামকে নিয়মমাফিক نَعْبُدُ ক্রিয়ার পরে না বসিয়ে পূর্বে বসানোর মূল কারণ হ’ল বক্তব্যের মধ্যে Emphasis বা জোর সৃষ্টি করা। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আগে বলাই আরবদের বাকরীতি। কেননা ‘তোমার ইবাদত করি’ বললে অন্যকেও ইবাদত করার সম্ভাবনা বাকী থাকে। কিন্তু ‘তোমারই ইবাদত করি’ বললে সে সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যায়। إِيَّاكَ সর্বনাম একই বাক্যে দু’বার অগ্রে বসানোর পিছনেও উদ্দেশ্য হ’ল একথা জোর দিয়ে বলা যে, আমাদের যাবতীয় ইবাদত ও ইস্তি‘আনাত বা উপাসনা ও সাহায্য প্রার্থনাকে আমরা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য খাছ করছি। অন্য কারু জন্য আমাদের হৃদয়ে কোন স্থান নেই (تجريد العبادة لله وحده)।
বিগত যুগের জনৈক বিদ্বান (بعض السلف) বলেন, সমগ্র কুরআনের মূল (سر القرآن) নিহিত রয়েছে সূরা ফাতিহার মধ্যে এবং সূরা ফাতিহার মূল নিহিত রয়েছে এই আয়াতটির মধ্যে। এর প্রথম অংশে শিরক হ’তে মুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে ও দ্বিতীয় অংশে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে কেবল তাঁর উপরেই ভরসা করা হয়েছে (ইবনু কাছীর)। এতদ্ব্যতীত ১ম তিনটি আয়াতে صيغه غائب বা নাম পুরুষ ব্যবহার করে অত্র আয়াতে صيغه حاضر বা মধ্যম পুরুষ ব্যবহার করে সরাসরি আল্লাহকে সম্বোধন করার মধ্যে তাঁর অধিকতর নিকটে পৌঁছে যাওয়ার ইংগিত প্রদান করা হয়েছে। প্রেমাস্পদের নিকটে ভক্ত প্রেমিক তার ব্যাকুল হৃদয়ের আকুল বাসনা সরাসরি নিবেদন করবে এটাই তো কাম্য। অত্র আয়াতের এই আলংকরিক দ্যোতনা মুমিন হৃদয়ে ভালবাসার ঢেউ তোলে। হাদীছে এসেছে, আল্লাহ বলেন যে, هَذَا بَيْنِى وَبَيْنَ عَبْدِى وَلِعَبْدِى مَا سَأَلَ ‘এই আয়াতের অর্ধেক আমার জন্য ও অর্ধেক বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে।[51] আল্লাহ বলেন, فَاعْبُدْهُ وَتَوَكَّلْ عَلَيْهِ وَمَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ ‘অতএব তুমি তাঁরই ইবাদত কর এবং তাঁর উপরেই নির্ভর কর। (মনে রেখো) তোমরা যা কিছু কর, তোমার প্রতিপালক তা থেকে অনবহিত নন’ (হূদ ১১/১২৩)। এর মধ্যে একটি বিষয়ে আশার সঞ্চার হয় যে, ইবাদত ও তাওয়াক্কুল নিখাদ হ’লে আল্লাহর সাহায্য অবশ্যম্ভাবী। ইবাদত ত্রুটিপূর্ণ হ’লে এবং তাওয়াক্কুলের মধ্যে খুলূছিয়াতের অভাব থাকলে বান্দার কামনা ও বাসনা পূরণ নাও হ’তে পারে। সাহায্য চাওয়ার পূর্বে ইবাদতের বিষয় উল্লেখ করার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এটাই।
বৈধ ও অবৈধ ইস্তি‘আনত :
‘ইস্তি‘আনাত’ বা সাহায্য চাওয়া ঐ সকল বিষয়ে যা মাখলূকের ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। এটা কোন দোষের কথা নয়। বরং প্রত্যেক নেকীর কাজে সাহায্য করার জন্য শরী‘আতে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, َتَعَاوَنُواْ عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى ‘তোমরা নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর’ (মায়েদাহ ৫/২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, وَاللهُ فِىْ عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِىْ عَوْنِ أَخِيْهِ ‘আল্লাহ তার বান্দার সাহায্যে অতক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে’।[52] এগুলি হ’ল বৈধ ইস্তি‘আনাত।
পক্ষান্তরে নিষিদ্ধ ইস্তি‘আনাত হ’ল, যে সকল বিষয়ে মাখলূকের কোন ক্ষমতা নেই, সেই সকল বিষয়ে মাখলূকের নিকটে সাহায্য চাওয়া। এটি অবৈধ এবং প্রকাশ্য শিরকের অন্তর্ভুক্ত। যেমন মৃত মানুষের নিকট সাহায্য চাওয়া, তার অসীলায় মুক্তি কামনা করা, তার আশ্রয় ভিক্ষা করা ইত্যাদি। আল্লাহ বলেন, إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى ‘নিশ্চয়ই তুমি শুনাতে পারো না মৃতদের’ (নামল ২৭/৮০; রূম ৩০/৫২)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَّنْ فِي الْقُبُوْرِ ‘তুমি কোন কবরবাসীকে শুনাতে পারো না’ (ফাত্বির ৩৫/২২)। অমনিভাবে সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, গাছ, পাথর, সাগর বা অনুরূপ সৃষ্টবস্ত্ত যাদের কোন ক্ষমতা নেই। তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন, لاَ تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلاَ لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا ِللهِ الَّذِيْ خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ ‘তোমরা সূর্যকে সিজদা করোনা এবং চনদ্রকেও না। বরং সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলি সৃষ্টি করেছেন। যদি তোমরা সত্যিকার অর্থে কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাক’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৭)। তিনি আরও বলেন, وَإِنْ يَّمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ ‘যদি আল্লাহ তোমার কোন অনিষ্ট করতে চান, তবে তিনি ব্যতীত কেউ নেই যে, তা দূর করে দেয়’... (আন‘আম ৬/১৭)।
নবী, অলি প্রভৃতি নেককার মৃত মানুষের নিকটে সাহায্য কামনা করা ও তাদের অসীলায় মুক্তি চাওয়াই হ’ল পৃথিবীর সর্বাধিক প্রাচীন ও আদিম শিরক। তারা বলতো هَـؤُلاَءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ الله ‘ওরা আমাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশকারী মাত্র’ (ইউনুস ১০/১৮)।* হযরত নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূল এই শিরকের বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। আল্লাহর সত্যিকারের নেক বান্দারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাবেন। অবশ্য সৃষ্টিকর্তা হিসাবে, প্রভু ও প্রতিপালক হিসাবে আল্লাহর নিকটে বান্দা যে কোন সময়ে যে কোন সাহায্য চাইতে পারে। আল্লাহ বলেন, اُدْعُوْنِيْ أَسْتَجِبْ لَكُمْ ‘তোমরা আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব’ (মুমিন/গাফের ৪০/৬০)। আল্লাহ তাঁর কোন মাখলূককে দিয়ে এই সাহায্য করে থাকেন। কেননা সকল বনু আদমের অন্তঃকরণ আল্লাহ পাকের দুই আংগুলের মধ্যে রয়েছে। তিনি ইচ্ছামত তা পরিচালিত করেন।[53]অতএব সকল বিষয়ে আল্লাহর নিকটে সাহায্য চাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
অত্র আয়াতে দু’টি বিষয় একত্রে বলা হয়েছে। এক- আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানার মাধ্যমে তাঁর প্রতি ইবাদতকে খালেছ (إخلاص العبادة لله وحده بامتثال أوامره واجتناب نواهيه) করা। দুই- সকল প্রকার অংশীবাদ থেকে মুক্ত হয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটে সাহায্য চাওয়াকে খালেছ (إخلاص الاستعانة بالله وحده باجتناب جميع الاشراك) করা।
আবু হাফছ আল-ফারগানী বলেন, যে ব্যক্তি অত্র আয়াতটি স্বীকার করে নিল, সে ব্যক্তি (فقد بَرِئَ من الْجَبْر وَالْقَدَرِ) জাবরিয়া (অদৃষ্টবাদী) ও ক্বাদারিয়া (তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী) আক্বীদা থেকে মুক্তি পেল’ (কুরতুবী)।
(৫) اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ ‘তুমি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর’।
هَدَى يَهْدِى هَدْيًا هُدًى هِدَايَةً অর্থ রাস্তা দেখানো। এটি ভাল ও মন্দ দু’অর্থেই আসতে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ ‘আর আমরা কি তাকে (ভাল ও মন্দ) দু’টি পথই দেখাই নি? (বালাদ ৯০/১০)। এখানে ‘হেদায়াত’ অর্থ সুপথ প্রদর্শন ও তার তাওফীক কামনা (الإرشاد والتوفيق)। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَإِنَّكَ لَتَهْدِيْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ‘নিশ্চয়ই তুমি সরল পথ প্রদর্শন করে থাক’ (শূরা ৪২/৫২)। অনুরূপভাবে জান্নাতবাসীরা আল্লাহকে বলবে, الْحَمْدُ للهِ الَّذِيْ هَدَانَا لِهَذَا وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلاَ أَنْ هَدَانَا اللهُ ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে এর পথ প্রদর্শন করেছেন। আর আল্লাহ আমাদের হেদায়াত না করলে আমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হ’তাম না’... (আ‘রাফ ৭/৪৩)।
অত্র আয়াতে اِهْدِنَا اِلَى الصِّرَاطَ বা لِلصِّرَاطَ না বলে ‘হরফে জার’ বিলুপ্ত করে সরাসরি اِهْدِنَا الصِّرَاطَ বলার মধ্যে কুরআনের উন্নত ভাষালংকার ফুটে উঠেছে। আর তা এই যে, এখানে হেদায়াত প্রার্থনাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
হেদায়াতের প্রকারভেদ :
হেদায়াত দু’প্রকারের। একটি হ’ল ইলমের হেদায়াত। যেমন আল্লাহ কুরআনকে هُدًى لِلْمُتَّقِينَ‘মুত্তাক্বীদের জন্য হেদায়াত’ (বাক্বারাহ ২) এবং هُدًى لِلنَّاسِ ‘মানবজাতির জন্য হেদায়াত’ (বাক্বারাহ ১৮৫) বলেছেন। সে বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য আল্লাহর হেদায়াত প্রয়োজন। অন্যটি হ’ল ইলম অনুযায়ী আমল করার তাওফীক লাভের হেদায়াত। কারণ ইসলামই যে সরল পথ, তার জ্ঞান অর্জন করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা, দু’টির জন্যই আল্লাহর হেদায়াত প্রয়োজন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا ثَمُوْدُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى عَلَى الْهُدَى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُونِ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُوْنَ ‘অতঃপর ছামূদ জাতি। তাদেরকে আমরা পথ প্রদর্শন করেছিলাম। কিন্তু তারা সৎপথের বিপরীতে ভ্রান্তপথ অবলম্বন করল। ফলে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ লাঞ্ছনাকর শাস্তি তাদের গ্রেফতার করে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৭)। এমনিভাবে যুগে যুগে অবিশ্বাসী ও কপট বিশ্বাসী লোকেরা করেছে ও করে চলেছে। আমরা যেন তা না করি, সেজন্য আল্লাহর নিকটে হেদায়াত প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে অত্র আয়াতে।
এখানে صِرَاط ও سِرَاط দু’টি ক্বিরাআত রয়েছে। দু’টিরই অর্থ ‘প্রশস্ত রাস্তা’। তবে صِرَاطশব্দটিই চালু। অতএব সেটাই পড়া উত্তম। নইলে ফিৎনা সৃষ্টি হবে। مُستَقِيْمَ ‘সরল’ ও ‘সুদৃঢ়’ যাতে কোন অাঁকা-বাঁকা নেই এবং যা ভঙ্গুর নয়।
الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ অর্থ الشريعة التى جاء بها الرسول صلى الله عليه وسلم ‘ঐ শরী‘আত যা নিয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আগমন করেছেন’। আর তা হ’ল ইসলাম। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلاَمُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। তিনি বলেন, وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلاَمِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না। আর আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوْتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন নিহিত তাঁর কসম করে বলছি, ইহুদী হৌক বা নাছারা হৌক এই উম্মতের যে কেউ আমার আগমনের খবর শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার উপরে ঈমান আনেনি, সে ব্যক্তি অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।[54]
অতএব আয়াতের অর্থ হ’ল, ‘তুমি আমাদেরকে ইসলামের সরল পথ প্রদর্শন কর’। ঐ পথ যা সুদৃঢ় ও অপরিবর্তনীয় এবং যা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটে পৌঁছে দেয়। যা আমাদেরকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়, আমাদেরকে হক-এর পথ দেখায় ও হক অনুযায়ী আমল করতে শিখায়’। এই দো‘আই হ’ল বান্দার জন্য আল্লাহর নিকটে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দো‘আ। আর সম্ভবতঃ একারণেই ছালাতের প্রতি রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে এই দো‘আ করা বান্দার জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে’ (তাফসীরে সা‘দী ১/৩৬ পৃঃ)। আর ছিরাতে মুস্তাক্বীম সর্বদা সরল, সুদৃঢ় ও অপরিবর্তনীয়। যুগ বা সমাজ তাকে পরিবর্তন করে না। বরং সেই-ই সবকিছুকে পরিবর্তন করে দেয় ও মানুষকে তার পথে পরিচালিত করে।
হেদায়াত-এর স্তরসমূহ :
এখানে هداية কথাটি নবী, অলী ও সাধারণ উম্মত এমনকি সকল মাখলূকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা প্রত্যেকের জন্য স্তরবিশেষে হেদায়াতের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন (১) হেদায়াতের ১ম স্তরে রয়েছে সমস্ত মাখলূক তথা জড়পদার্থ, উদ্ভিদ, প্রাণীজগত ইত্যাদি। এদের মধ্যে প্রয়োজনীয় বুদ্ধি ও অনুভূতির অস্তিত্ব রয়েছে। এরা সকলেই আল্লাহর হেদায়াত অনুযায়ী স্ব স্ব নিয়মে আল্লাহর গুণগান করে থাকে। যেমন এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কি জানো না যে, আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবকিছুই আল্লাহর গুণগান করে থাকে? বিশেষ করে পক্ষীকুল যারা সারিবদ্ধভাবে উড়ে বেড়ায়। প্রত্যেকই স্ব স্ব দো‘আ ও তাসবীহ সম্পর্কে জ্ঞাত। আল্লাহ তাদের কর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (নূর ২৪/৪১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, الَّذِيْ أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى ‘যিনি প্রত্যেক বস্ত্তর বিশেষ আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর তার উপযোগী হেদায়াত প্রদান করেছেন’ (ত্বোয়াহা ২০/৫০)। এজন্যেই পশু-পক্ষী প্রত্যেকে আল্লাহ প্রদত্ত বোধশক্তি অনুযায়ী চলাফেরা করে। আদৌ অবাধ্যতা করে না। পবিত্র কুরআনের এই বৈজ্ঞানিক আয়াত থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই ইবনুল মাসকাভী (৯৩২-১০৩০ খৃঃ) প্রমুখ মুসলিম বিজ্ঞানী বৃক্ষের জীবন ও অনুভূতি প্রমাণ করেন। এর বহু পরে ঢাকার খ্যাতিমান বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭ খৃঃ) ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে তাতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন। বহুকাল পূর্বে হযরত সুলায়মান (আঃ) পক্ষীকুল এমনকি পিঁপড়ার ভাষা বুঝতেন (নমল ২৭/১৮)। আধুনিক বিজ্ঞান এখনো ততদূর এগোতে পারেনি।
(২) হেদায়াতের ২য় স্তরে রয়েছে জিন ও ইনসান জাতি, যারা অন্যান্য সৃষ্টির চাইতে তীক্ষ্ণধী ও উচ্চ জ্ঞানসম্পন্ন। আল্লাহর পক্ষ হ’তে নবীগণের মাধ্যমে এদের নিকটে হেদায়াত পাঠানো হয়েছে। কেউ তা গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। কেউ প্রত্যাখ্যান করে হতভাগা হয়েছে।
(৩) হেদায়াতের ৩য় স্তর হ’ল মুমিন-মুত্তাক্বীদের জন্য, যাতে তারা অধিকতর নেক বান্দা হওয়ার তাওফীক লাভ করেন। আল্লাহর দেওয়া তাওফীক অনুযায়ী এই স্তর বিন্যাস হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহপাক বলেন,تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ ‘এই রাসূলগণ! আমরা তাদের একে অপরের উপর মর্যাদা দিয়েছি। তাদের মধ্যে কারু সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং কারু মর্যাদা উচ্চতর করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৫৩)। এই তৃতীয় স্তরই মানুষের প্রকৃত উন্নতির ক্ষেত্র। এই স্তরের মানুষেরা অধিকতর হেদায়াত লাভের জন্য সর্বদা আল্লাহর রহমত ও তাওফীক লাভে সচেষ্ট থাকেন। প্রতিনিয়ত এই প্রচেষ্টাই মানুষকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। এমনকি এক সময় সে ফেরেশতাদের চাইতে উন্নত মর্যাদায় আসীন হয়। নবী-রাসূলগণ এই স্তরে আছেন। যেকারণে মে‘রাজ রজনীতে জিব্রীলকে ছেড়ে রাসূল (ছাঃ) শেষ মুহূর্তে একাকী আল্লাহর দীদার লাভে সক্ষম হন। والله ولى التوفيق।[55]
অতএব মানুষ যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, সর্বদা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে প্রদত্ত আল্লাহর হেদায়াত সমূহ অনুসরণে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের সরলপথ ধরে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পানে জান্নাত লাভের বাসনা নিয়ে, এটাই হ’ল অত্র আয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য।
হেদায়াত লাভের এই দো‘আর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, উঁচু-নীচু সকল পর্যায়ের মানুষেরই সর্বদা সর্বাবস্থায় আল্লাহর হেদায়াত প্রয়োজন রয়েছে। ‘নবী-অলীগণ হেদায়াত প্রাপ্ত। অতএব তাঁদের আর ইবাদত প্রয়োজন নেই’ এই ধারণার মূলোৎপাটন করা হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে। বরং একথাই সত্য যে, উপরে বর্ণিত সকল স্তরের ও সকল পর্যায়ের লোকের জন্য ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর হেদায়াত সকল সময় যরূরী। সর্বদা সেই হেদায়াত প্রার্থনার জন্য আল্লাহ স্বীয় বান্দাকে অত্র আয়াতে শিক্ষা দিচ্ছেন।
এক্ষণে হেদায়াত লাভের পথ কি- সে বিষয়ে অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ‘যারা আমার রাস্তায় সংগ্রাম করে, আমরা অবশ্যই তাদেরকে আমার রাস্তাসমূহ দেখিয়ে থাকি’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)।
‘জিহাদ’ অর্থ ‘সংগ্রাম’ ও ‘সর্বাত্মক প্রচেষ্টা’। যার চূড়ান্ত পর্যায় হ’ল ইসলাম ও কুফরের মধ্যেকার সশস্ত্র যুদ্ধ। অতএব যারা কথা, কলম ও সংগঠন-এর মাধ্যমে সর্বদা আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শাহাদাত লাভের আকাংখা নিয়ে সর্বদা সমাজ সংস্কারে লিপ্ত থাকবে, আল্লাহপাক ঐ সকল মুজাহিদ বান্দাকে তাঁর হেদায়াতের রাস্তাসমূহ খুলে দেবেন ইনশাআল্লাহ।
এখানে নবী-রাসূল ও আলেমগণের মাধ্যমে হেদায়াত লাভের বিষয়টি ছাড়াও আরেকটি বিষয় কুরআন ও হাদীছে এসেছে, সেটি হ’ল প্রত্যেক মানুষের মধ্যে লুক্কায়িত ‘তিরস্কারকারী আত্মা’ اَلنَّفْسُ اللَّوَّامَةُ) ; ক্বিয়ামাহ ৭৫/২) রয়েছে, যাকে হাদীছে وَاعِظُ اللهِ فِىْ قَلْبِ كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের হৃদয়ে অবস্থিত আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত উপদেশদানকারী’ বলা হয়েছে। হাদীছের ভাষায় যা সর্বদা বিপথগামী মুমিনকে আল্লাহর পথে ডাকে ও অন্যায় পথে যেতে নিষেধ করে।[56] বান্দাকে অন্যায় পথ থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নেওয়ার জন্য এটাও আল্লাহ প্রদত্ত একটি চিরন্তন হেদায়াত, যার ফলে মানবতা এখনো টিকে আছে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيْهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيْمَانِهِمْ ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের পালনকর্তা তাদের পথ প্রদর্শন করেন তাদের ঈমানের মাধ্যমে’ (ইউনুস ১০/৯)।
(৬) صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ‘ঐ সকল ব্যক্তিদের পথ যাদেরকে তুমি পুরস্কৃত করেছ’।
صِرَاطَ (পথ), এখানে পূর্ববর্তী صِرَاطَ হ’তে بدل হয়েছে।
কাদেরকে আল্লাহ পুরস্কৃত করবেন, এ সম্পর্কে অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ ‘তারা হলেন নবীগণ, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল বান্দাগণ’ (নিসা ৪/৬৯)।
(৭) غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّيْنَ ‘তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে’। এখানে غير এবং لا একই অর্থে এসেছে।
অত্র আয়াতে বর্ণিত ‘মাগযূব’ (অভিশপ্ত) এবং ‘যা-ল্লীন’ (পথভ্রষ্টগণ) কারা, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, هُمُ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى ‘তারা হ’ল ইয়াহূদ ও নাছারাগণ’।[57] ইবনু আবী হাতেম বলেন যে, এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে কোন মতভেদ আছে বলে আমি জানি না’।[58]ইহুদীরা তাদের নবীদেরকে হত্যা করে এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে অভিশপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে নাছারারা তাদের নবী ঈসা (আঃ)-কে অতিরঞ্জিত করে আল্লাহর আসনে বসিয়ে এবং শেষনবী (ছাঃ)-কে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে ও তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা করে পথভ্রষ্ট হয়েছে।
অতএব ‘মাগযূব’ হ’ল ইহুদীরা এবং যুগে যুগে ঐসব লোকেরা, যারা ইহুদীদের মত হক জেনেও তার উপর আমল করে না। ‘যাল্লীন’ হ’ল নাছারাগণ এবং যুগে যুগে ঐসব লোক, যারা নাছারাদের মত মূর্খতাবশে হক বিরোধী আমল করে। মানুষ হক প্রত্যাখ্যান করে মূলতঃ হঠকারিতা ও অজ্ঞতার কারণে। দু’টির মধ্যে কঠিনতর হ’ল হঠকারিতার দোষ। যে কারণে ইহুদীরা স্থায়ীভাবে অভিশপ্ত হয়েছে। অত্র আয়াতে সেজন্য তাদেরকে আগে আনা হয়েছে ও পরে নাছারাদের কথা এসেছে।
এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, ইহুদী-নাছারাদের স্বভাব যেন মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ না করে এবং তারা যেন ঐ দুই জাতির হীন তৎপরতা ও তাদের মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সর্বদা হুঁশিয়ার থাকে। কেননা তারা ইসলামের স্থায়ী শত্রু। যেমন অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَتَّخِذُوا الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইয়াহূদ ও নাছারাদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না (মায়েদাহ ৫/৫১)। তবে দুনিয়াবী ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য কাফির-মুশরিকদের সাথে বাহ্যিকভাবে সম্পর্ক রাখার অনুমতি রয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছে, لاَ يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُوْنَ الْكَافِرِيْنَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِيْنَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللهِ فِيْ شَيْءٍ إِلاَّ أَنْ تَتَّقُوْا مِنْهُمْ تُقَاةً ‘মুমিন ছাড়া কোন কাফিরকে মুমিনগণ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে না। যদি কেউ এটা করে, তবে তাদের সঙ্গে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি কি-না তোমরা তাদের থেকে কোনরূপ অনিষ্টের আশংকা কর (তবে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখা যাবে)। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজ সত্তার ভয় দেখাচ্ছেন। (মনে রেখ) সবাইকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে’ (আলে ইমরান ৩/২৮)। একারণে ইসলাম ও ইসলামী খেলাফতের মৌলিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণকারী বিষয়সমূহ বাদে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকুরী-বাকুরী ইত্যাদি বিষয়ে অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার ব্যাপারে কোন আপত্তি নেই।
৫ম আয়াতে বর্ণিত ছিরাতে মুস্তাক্বীমের ব্যাখ্যা এসেছে ৬ষ্ঠ ও ৭ম আয়াতে। এখানে মোট তিন প্রকার মানুষের কথা বলা হয়েছে। এক- যাদেরকে আল্লাহ পুরস্কৃত করেছেন (أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ)। এখানে পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি সরাসরি আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে। দুই- যারা অভিশপ্ত হয়েছে (الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ)। এদের মধ্যে সেরা হ’ল ইহুদী জাতি। যারা যিদ ও অহংকার বশে অভিশপ্ত হয়েছে। তিন- যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে (الضَّالِّيْنَ)। যারা মূর্খতা ও যিদ বশতঃ পথভ্রষ্ট হয়েছে। যাদের শীর্ষে রয়েছে নাছারাগণ। ফলে ইহুদী ও নাছারা উভয় জাতিই এক স্তরে চলে গেছে।
উক্ত তিন জাতির মধ্যে সর্বযুগে মুক্তিপ্রাপ্ত দল হ’ল তারাই, যারা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের অনুসারী হয়েছে। আখেরী যামানায় তারা হ’ল কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী দল।[59]মুসলিম উম্মাহ ইহুদী-নাছারাদের মত পথভ্রষ্ট হবে এবং তারা ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। যার মধ্যেকার একটি দল মাত্র জান্নাতী হবে। যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের তরীকার উপর দৃঢ় থাকবে’।[60] তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত হক-এর উপর বিজয়ী থাকবে।[61]তাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিচিতি হবে ‘আহলুল হাদীছ’ হিসাবে।[62] আল্লাহ বলেন, وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ‘আর এটাই হ’ল আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এর অনুসরণ কর। এ পথ ছেড়ে অন্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এই নির্দেশ দিচ্ছেন, যাতে তোমরা ঐসব পথ থেকে বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।
উল্লেখ্য যে, অত্র আয়াতে ক্বাদারিয়া, মু‘তাযিলা, ইমামিয়া প্রভৃতি ভ্রান্ত ফের্কার প্রতিবাদ রয়েছে। কেননা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ নিজেই তার ভাল-মন্দ সকল কর্মের স্রষ্টা। অতএব সরল পথের জন্য আল্লাহর নিকটে হেদায়াত প্রার্থনার কোন প্রয়োজন নেই। অথচ এখানে যেমন সরল পথের হেদায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে, তেমনি অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্টদের পথে না যাওয়ার জন্যও আল্লাহর হেদায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে। এজন্য আমরা প্রার্থনা করব, رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! হেদায়াত দানের পর আমাদের অন্তর সমূহকে বক্র করে দিয়ো না। আমাদেরকে তোমার নিকট থেকে রহমত দান কর। নিশ্চয়ই তুমি মহান দাতা’ (আলে ইমরান ৩/৮)।
آمين অর্থ اَللَّهُمَّ اسْتَجِبْ ‘হে আল্লাহ তুমি কবুল কর’। এটি إسم فعل অর্থাৎ বাহ্যতঃ ইস্ম (বিশেষ্য) আকারে হলেও তা ফে‘ল অর্থাৎ ক্রিয়াপদের অর্থ দেয়। آمين আলিফ-এর উপরে ‘মাদ্দ’ ياسين -এর ওযনে অথবা ‘যবর’ يَمِيْن -এর ওযনে দু’ভাবেই পড়া জায়েয আছে।[63]
সূরা ফাতিহা পাঠ শেষে ‘আমীন’ বলা সুন্নাত। যৎসামান্য বিরতি দিয়ে এটা বলবে। যাতে সূরার সাথে মিলে না যায়। জেহরী ছালাতে সরবে ও সের্রী ছালাতে নীরবে ‘আমীন’ বলবে। ইমামের পিছনে জেহরী ছালাতে মুক্তাদী সরবে ‘আমীন’ বলবে, না নীরবে বলবে এ বিষয়ে কিছু বিদ্বান মতভেদ করেছেন। তবে ছহীহ মরফূ হাদীছকে অগ্রাধিকার দিলে জেহরী ছালাতে ইমাম ও মুক্তাদী সকলকে নিঃসন্দেহে ‘আমীন’ সরবে বলতে হবে।[64] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যখন ইমাম ‘ওয়ালায্ যা-ল্লীন’ পাঠ শেষ করে কিংবা ‘আমীন’ বলে, তখন তোমরা সকলে ‘আমীন’ বল। কেননা যার ‘আমীন’ আসমানে ফেরেশতাদের ‘আমীন’-এর সাথে মিলে যাবে, তার পূর্বেকার সকল গুনাহ মাফ করা হবে’।[65]
অতএব হাদীছে বর্ণিত জেহরী ছালাতে সশব্দে ‘আমীন’ বলার বিশুদ্ধ সুন্নাতের উপরে আমল করাই নিরপেক্ষ মুমিনের কর্তব্য। তাছাড়া ইমামের সশব্দে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ শেষে ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীম’-এর হেদায়াত প্রার্থনার সাথে মুক্তাদীগণের নীরবে সমর্থন দান কিছুটা বিসদৃশ বৈ-কি!
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْيَهُوْدَ قَوْمٌ حُسَّدٌ، وَإِنَّهُمْ لاَ يَحْسُدُوْنَا عَلَى شَيْءٍ كَمَا يَحْسُدُوْنَا عَلَى السَّلاَمِ وَعَلَى آمِيْنَ. ‘ইহুদীরা হিংসুক জাতি। তারা আমাদেরকে বেশী হিংসা করে আমাদের পারস্পরিক ‘সালাম’ বিনিময়ের কারণে এবং (সূরা ফাতিহা শেষে) ‘আমীন’ বলার কারণে’।[66] কারণ ইহুদী ও নাছারাদের পথে না গিয়ে ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর হেদায়াত চেয়ে সূরা ফাতিহার শেষে যে দো‘আ করা হয় এবং ইমাম ও মুক্তাদী সকলে সমস্বরে ‘আমীন’ বলে আল্লাহর নিকটে যে সমবেত প্রার্থনা করা হয়, এটা তারা বরদাশ্ত করতে পারে না।
উপসংহার :
সূরা ফাতিহা হ’ল পবিত্র ‘কুরআনের সারনির্যাস’। এর মধ্যে সমগ্র কুরআনের মূল বিষয়বস্ত্ত সমূহ নিহিত রয়েছে। তাওহীদ, আহকাম ও নছীহতের ত্রিবিধ সমাহার আছে এ সূরাতে। তাওহীদে রুবূবিয়াত যেমন ফুটে উঠেছে ১ম আয়াতের মধ্যে, তাওহীদে আসমা ও ছিফাত তেমনি ফুঠে উঠেছে ১ম, ২য় ও ৩য় আয়াতে। যারা নিরেট একত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে আল্লাহকে গুণহীন সত্তা মনে করেন, তাদের সেই ভুল ধারণার প্রতিবাদ রয়েছে এই আয়াতগুলিতে। ৪র্থ আয়াতে তাওহীদে ইবাদত বা উলূহিয়াতের বিষয়ে যেমন সুস্পষ্ট বক্তব্য এসেছে, তেমনি ‘আব্দ ও মা‘বূদ-এর পার্থক্য এবং ‘আব্দ-এর করণীয় সম্পর্কেও বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘আব্দ কেবল ইবাদত করবে ও সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং মা‘বূদ উক্ত ইবাদত কবুল করবেন ও সাহায্য প্রদান করবেন। অত্র আয়াতে সৃষ্টি স্রষ্টার অংশ হওয়া (যেমন বলা হয় ‘যত কল্লা তত আল্লা’) এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির একই সত্তায় লীন (ফানা ফিল্লাহ) হওয়ার অদ্বৈতবাদী দর্শনের তীব্র প্রতিবাদ রয়েছে। অতঃপর ৫ম আয়াতটি হ’ল এই সূরার প্রাণ। যেখানে বান্দার পক্ষ হ’তে আল্লাহর নিকটে ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’-এর হেদায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে। সমস্ত কুরআন যার জওয়াব হিসাবে এসেছে।
দ্বীনের আরকান-আহকামের উপরে আমল ব্যতীত শুধুমাত্র দো‘আ ও প্রার্থনা দিয়ে কোন কাজ হবে না, যা অদৃষ্টবাদী জাবরিয়া দর্শনের প্রতিবাদ করে। অনুরূপভাবে শুধু আমল দিয়েও কাজ হবে না, যদি না সেখানে আল্লাহর রহমত থাকে। সেজন্য আল্লাহর নিকটে হেদায়াত প্রার্থনা করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যা ক্বাদারিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত বিশ্বাসীদের প্রতিবাদ করে। কেননা তারা মানুষকেই তার ভাল-মন্দ কর্মের স্রষ্টা মনে করে। ৬ষ্ঠ আয়াতে পুরস্কারপ্রাপ্ত সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আকাংখা ব্যক্ত করা হয়েছে। পরিশেষে ৭ম আয়াতে ইহুদীদের মত অভিশপ্ত ও নাছারাদের মত পথভ্রষ্ট না হওয়ার জন্য মুসলিম উম্মাহকে সাবধান করে সূরা ফাতিহার উপসংহার টানা হয়েছে।
আল্লাহ আমাদেরকে ছিরাতে মুস্তাক্বীমে পরিচালিত করুন -আমীন!
সারকথা :
মানবতার প্রকৃত রূপ বিকশিত হওয়ার জন্য সরল পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে অত্র সূরায়।
[1]. এটি সূরা নমলের ৩০ আয়াত। যা সূরা তওবা ব্যতীত প্রতিটি সূরার শুরুতে পার্থক্যকারী হিসাবে পঠিত হয়। এতে ৪টি শব্দ ও ১৯টি বর্ণ রয়েছে।
[2]. তিরমিযী হা/২৯১০, দারেমী; মিশকাত হা/২১৩৭ ‘কুরআনের ফযীলতসমূহ’ অধ্যায়।
[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৯, ‘ছওম’ অধ্যায়।
[4]. আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আনছারী আল-খাযরাজী আল-কুরতুবী (মৃঃ ৬৭১ হিঃ/১২৭৩ খৃঃ), আল-জামে‘ লি আহকামিল কুরআন, ওরফে তাফসীরুল কুরতুবী, তাহকীক : আব্দুর রাযযাক আল-মাহদী (বৈরূত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী ১৪২৪/২০০৪ খৃঃ) ১/১৫০ পৃ:।
[5]. ইমাদুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল বিন ওমর ইবনু কাছীর আল-কুরায়শী আদ-দিমাশক্বী (৭০১-৭৪ হিঃ/১৩০১-৭৩ খৃঃ), তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ওরফে তাফসীর ইবনু কাছীর (কায়রো : দারুল হাদীছ ১৪২৩ হিঃ/২০০২ খৃঃ), ১/৪৮ পৃ:।
[6]. যেমন হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত মরফূ হাদীছে এসেছে- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أُمُّ الْقُرْآنِ هِىَ السَّبْعُ الْمَثَانِى وَالْقُرْآنُ الْعَظِيمُ (বুখারী হা/৪৭০৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়, ‘সূরা হিজর’ অনুচ্ছেদ; আহমাদ হা/৯৭৮৭, সনদ ছহীহ)। অন্য বর্ণনায় এসেছে- وقال أيضا اَلْحَمْدُ ِللهِ أُمُّ الْقُرْآنِ وَأُمُّ الْكِتَابِ وَالسَّبْعُ الْمَثَانِى (তিরমিযী হা/৩১২৪, আবুদাঊদ হা/১৪৫৭, সনদ ছহীহ)।
[7]. বুখারী, ‘তাফসীর’ অধ্যায়-৬৫, অনুচ্ছেদ-১ ‘ফাতিহাতুল কিতাব’-এর শুরুতে।
[8]. হিজর ১৫/৮৭; বুখারী তা‘লীক্ব হা/৪৭০৪; আহমাদ হা/৯৭৮৭, তিরমিযী হা/৩১২৪, আবুদাঊদ হা/১৪৫৭।
[9]. মুসলিম হা/৩৯৫, নাসাঈ হা/৯০৯; মিশকাত হা/৮২৩।
[10]. বুখারী হা/৫৭৩৬, মুসলিম হা/২২০১।
[11]. বুখারী হা/৭৫৬, মুসলিম হা/৩৯৪, ৮০৬; মিশকাত হা/৮২২, ২১২৪।
[12]. দারেমী হা/৩৩৭০, মুহাক্কিক : হুসাইন আসাদ সালীম, সনদ মুরসাল ছহীহ; মিশকাত হা/২১৭০।
[13]. আব্দুস সাত্তার দেহলভী, তাফসীরে সূরায়ে ফাতিহা (করাচী : মাকতাবা আইয়ূবিয়াহ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৩৮৫/ ১৯৬৫), পৃঃ ৬৮-৯২। গৃহীত : ‘খাযীনাতুল আসরার’; সুয়ূতী, ‘আল-ইতক্বান’; ভুপালী, ‘আদ-দীনুল খালিছ’।
[14]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২০৯৮-৯৯; বুখারী হা/৪৫৩৬; তাফসীর কুরতুবী ১/৬০।
[15]. ইবনু কাছীর ৪/৫৬৪।
[16]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৩-এর ব্যাখ্যা, ১/৩৭; ঐ, হা/৪৯২৬ ‘তাফসীর’ অধ্যায়-৬৫, অনুচ্ছেদ-৫।
[17]. ইবনু কাছীর ৮/২৩৫। গৃহীত : ত্বাবারাণী, সনদ যঈফ, তাহকীক ইবনু কাছীর।
[18]. মান্না‘ আল-ক্বাত্ত্বান, মাবাহিছ ফী উলূমিল কুরআন (কায়রো : মাকতাবা ওয়াহবাহ, ১৩শ সংস্করণ ২০০৪ খৃঃ) পৃঃ ৬৪।
[19]. তিরমিযী হা/৩৩৮৩, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৩০৬।
[20]. আবুদাঊদ, তিরমিযী হা/৩৪৭৬, মিশকাত হা/৯৩০, ৯৩১।
[21]. বুখারী হা/৭৫৬, মুসলিম হা/৩৯৪, মিশকাত হা/৮২২, উবাদা বিন ছামেত (রাঃ) হ’তে।
[22]. বুখারী হা/৪৭০৩; আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২১৪২।
[23]. মুসলিম হা/৮০৬ অধ্যায়-৬, ‘সূরা ফাতিহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৪৩, মিশকাত হা/২১২৪।
[24]. তুহফা হা/২৪৭-এর ভাষ্য।
[25]. মুসলিম হা/৩৯৫, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮২৩।
[26]. বুখারী হা/৭৫৬, মুসলিম হা/৩৯৪, মিশকাত হা/৮২২ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; কুতুবে সিত্তাহ সহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে উক্ত হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে।
[27]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৪৯০, ১/২৪৭-৪৮ পৃঃ সনদ ছহীহ। أجزأ الشيئ فلانا اي كفاهঅর্থাৎ ‘এটি তার জন্য যথেষ্ট হয়েছে’ ; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব ১১৯-২০ পৃঃ।
[28]. বুখারী হা/৫৭৩৭ ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়; মিশকাত হা/২৯৮৫।
[29]. বুখারী হা/৫৭৩৬, মুসলিম হা/২২০১ ‘সালাম’ অধ্যায়; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর।
[30]. তাফসীর কুরতুবী ১/১৪৮-৪৯।
[31]. তাফসীর ইবনু কাছীর ১/৬০; কুরতুবী ১/১২১, ১৩৪।
[32]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো : দারুশ শাবাব, ১৩৯৮/১৯৭৮), ৩/৩৬-৩৯; সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো : দারুল ফাত্হ, ৫ম সংস্করণ ১৪১২/১৯৯২), ১/১১২; তাফসীর কুরতুবী ১/১২১।
[33]. নায়লুল আওত্বার ৩/৪৬, ৫২; কুরতুবী ১/১২৮-১৩১।
[34]. ইবনু খুযায়মাহ হা/৪৯৩; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/২৪৭৯; ইরওয়া হা/৩৪৩। নায়লুল আওত্বার ৩/৪৩-৪৫।
[35]. নামল ২৭/২৯-৩০ (قَالَتْ يَا أَيُّهَا المَلَأُ إِنِّيْ أُلْقِيَ إِلَيَّ كِتَابٌ كَرِيْمٌ، إِنَّهُ مِنْ سُلَيْمَانَ وَإِنَّهُ بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ)
[36]. কুরতুবী ১/১৩৩।
[37]. বুখারী হা/৭৪২২, মুসলিম হা/২৭৫১, মিশকাত হা/২৩৬৪।
[38]. তিরমিযী হা/৬০৬, মিশকাত হা/৩৫৮, সনদ ছহীহ।
[39]. তিরমিযী, আবুদাঊদ হা/৩৭৬৭, মিশকাত হা/৪২০২।
[40]. মুসলিম হা/২২০২, মিশকাত হা/১৫৩৩; কুরতুবী ১/৯৮।
[41]. মুসলিম হা/২৮১৭, মিশকাত হা/২৩৭২।
[42]. মুসলিম হা/৩৯৫; মিশকাত হা/৮২৩।
[43]. কুরতুবী ১/১২৯-১৩০; আলোচনা দ্রষ্টব্য ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) ৪র্থ সংস্করণ, পৃ: ৮৬-৮৭।
[44]. মুসলিম হা/৩৯৯, আহমাদ হা/১৩৩৬১।
[45]. ইবনু মাজাহ হা/৩৮০৩; ছহীহাহ হা/২৬৫।
[46]. তিরমিযী হা/৩৩৮৩, মিশকাত হা/২৩০৬।
[47]. তাফসীর কুরতুবী ১/১৩৯; বুখারী হা/৬৪৬৯; মুসলিম হা/২৭৫৫, মিশকাত হা/২৩৬৭।
[48]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৩৬৫ ‘দো‘আসমূহ’ অধ্যায়-৯, ‘আল্লাহর রহমতের প্রশস্ততা’ অনুচ্ছেদ-৫।
[49]. মুসলিম হা/৪৯৪৬, মিশকাত হা/২৩৬৬।
[50]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/২৩৬৪।
[51]. মুসলিম হা/৩৯৫; মিশকাত হা/৮২৩।
[52]. মুসলিম হা/২৬৯৯, মিশকাত হা/২০৪ ‘ইল্ম’ অধ্যায়।
[53]. মুসলিম হা/২৬৫৪, মিশকাত হা/৮৯।
[54]. মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০।
[55]. হেদায়াত-এর ব্যাখ্যা আরও দেখুন সূরা আ‘লা ২-৩ আয়াতের তাফসীরে।
[56]. আহমাদ হা/১৭৬৭১, মিশকাত হা/১৯১ ‘ঈমান’ অধ্যায়; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৮৮৭।
[57]. তিরমিযী হা/২৯৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৮২০২।
[58]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর।
[59]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮; মিশকাত হা/১৮৬।
[60]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৭১।
[61]. মুসলিম হা/১৯২০।
[62]. তিরমিযী হা/২১৯২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭০২; ছহীহাহ হা/২৭০; মিশকাত হা/৬২৮৩।
[63]. তাফসীর কুরতুবী ১/১৭১; ইবনু কাছীর ১/৯৭।
[64]. দ্রঃ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) সংশ্লিষ্ট অধ্যায়; নায়লুল আওত্বার ৩/৭১-৭৫।
[65]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৮২৫, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; মুওয়াত্ত্বা (মুলতান, পাকিস্তান ১৪০৭/১৯৮৬) হা/৪৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়, পৃঃ ৫২।
[66]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৫৮৫; ইবনু মাজাহ হা/৮৫৬।
No comments